বাংলাদেশে কোম্পানি, বাণিজ্য সংগঠন, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সোসাইটি গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নামের ছাড়পত্র, নিবন্ধন, রিটার্ন ফাইলিং, প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদানসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিয়ে থাকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)।
ব্যবসা শুরু করা হোক বা বন্ধ—প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন হয় আরজেএসসির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ও সনদ। অথচ উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিভ্রান্ত হন ঠিক কোথায় আবেদন করতে হবে, কত ফি লাগবে বা কোন কাগজ লাগবে, তা নিয়ে।
আরজেএসসি থেকে কয়েক ধরনের সেবা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে নামের ছাড়পত্র, প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, রিটার্ন ফাইলিং, প্রত্যয়িত অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) প্রদান, প্রতিষ্ঠান অবসায়ন (উইন্ডিং আপ) ও স্ট্রাক অফ।
নামের ছাড়পত্র
নামের ছাড়পত্র হলো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের প্রথম ধাপ। আপনি যে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করতে চান, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত নামে আগে থেকেই কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়ে আছে কি না, তা এ ধাপে খুঁজে দেখা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, যাতে একই নামে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না হয়।
উদ্যোক্তাদের নতুন যেকোনো প্রতিষ্ঠানের (বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিস ও ব্রাঞ্চ অফিস ব্যতীত) নিবন্ধনের আগে আবশ্যিকভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের নামের ছাড়পত্র নিতে হয়। নামের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য সেবার আবেদনের জন্য প্রথমেই আরজেএসসির ওয়েবসাইটে https://app.roc.gov.bd/ নিবন্ধন করতে হয়। এরপর নির্ধারিত অপশনে গিয়ে নামের ছাড়পত্রের আবেদন করতে হয়। এ জন্য নির্ধারিত মাশুল (ফি) ব্যাংকে জমা দিতে হয়।
ছাড়পত্রের আবেদন ও নির্ধারিত ফি জমার পরে এরই মধ্যে নিবন্ধিত, ছাড়পত্র পাওয়া বা আবেদনকৃত কোনো নামের সঙ্গে মিলে না গেলে আরজেএসসি প্রস্তাবিত নামের ছাড়পত্র দেয়। নামের এ ছাড়পত্রটি ৩০ দিন পর্যন্ত বহাল থাকে। এর মধ্যেই নিবন্ধনের জন্য আবেদন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফি জমা দিতে হয়। অন্যথায় নামের ছাড়পত্রটি বাতিল হয়ে যায়।
প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন
আরজেএসসির ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে। এ জন্য উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠানের নামের ছাড়পত্র এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র, ফিসহ নির্ধারিত আবেদন ফরমের মাধ্যমে আবেদন করবেন। আবেদনের সঙ্গে আরজেএসসির নির্ধারিত ফরম্যাটে প্রতিষ্ঠানের যথাযথ মোমোরেন্ডাম বা আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন জমা দিতে হবে।
রিটার্ন ফাইলিং
আরজেএসসির আরেকটি সেবা হচ্ছে রিটার্ন ফাইলিং। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে তাদের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা–সম্পর্কিত হালনাগাদ সব তথ্য ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র আরজেএসসির কাছে নির্ধারিত সময়ে ও ফরমে পাঠাতে হয়। মোট দুই ধরনের রিটার্ন ফাইলিং রয়েছে—১. বার্ষিক রিটার্ন ফাইলিং ও ২. যেকোনো পরিবর্তনের জন্য দেওয়া রিটার্ন ফাইলিং।মূলত প্রতিষ্ঠানগুলো রিটার্ন পাঠায় আরজেএসসিতে এসব তথ্য সংরক্ষণের (ফাইলিং) জন্য। রিটার্ন ফাইলিং ও বিলম্ব রিটার্ন ফাইলিংয়ের (যদি প্রযোজ্য হয়) জন্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হয়। পরে আরজেএসসি এসব রিটার্নকে যাচাই করে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য দেয়, তাহলে আরজেএসসি তা সংশোধনের জন্য তাদের জানায়। শুধু অনুমোদিত রিটার্নই আরজেএসসি সংরক্ষণ করে।
প্রত্যয়িত অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) গ্রহণ
আরজেএসসি হলো বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র কর্তৃপক্ষ, যেখানে সব ধরনের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের (কোম্পানি, বাণিজ্য সংগঠন, সোসাইটি বা অংশীদারি প্রতিষ্ঠান) রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের এক বা একাধিক রেকর্ডের প্রত্যয়িত অনুলিপি পাওয়ার জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন। এমন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত ফি পাওয়া সাপেক্ষে আরজেএসসি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত রেকর্ডের প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদান করে থাকে। তবে কোম্পানির লাভ ও ক্ষতির হিসাব শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছেই প্রকাশ করা হয়।
প্রতিষ্ঠান অবসায়নের সনদ (উইন্ডিং আপ)
একটি কোম্পানি আদালতের রায়ের মাধ্যমে কিংবা স্বেচ্ছায়—এই দুই উপায়ে বন্ধ বা বিলুপ্ত হতে পারে। আদালতের মাধ্যমে উইন্ডিং আপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোম্পানি কিংবা কোম্পানির এক বা একাধিক ক্রেডিটর বা নিবন্ধক আদালতে পিটিশন জমা দেন। পিটিশন উপস্থাপনের সময় থেকেই আদালত কর্তৃক কোম্পানির উইন্ডিং আপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে ধরা হয়। এরপর আদালতের আদেশের অনুলিপি গেজেট আকারে প্রকাশ হয়।
তবে কোনো পাওনাদার বা অবদানকারীর আবেদন বিবেচনায় আদালত উইন্ডিং আপের প্রক্রিয়া স্থগিতের আদেশ দিতে পারেন। আদালত অফিশিয়াল রিসিভার ব্যতীত অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে উইন্ডিং আপের প্রক্রিয়ার জন্য লিকুইডেটর (অবসায়ক) হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।
অন্যদিকে স্বেচ্ছায় উইন্ডিং আপের জন্য একটি কোম্পানিকে রেজল্যুশন, বিশেষ রেজল্যুশন বা এক্সট্রা অর্ডিনারি রেজল্যুশন গ্রহণ করতে হয়। এই রেজল্যুশন গ্রহণের সময় থেকেই স্বেচ্ছায় উইন্ডিং আপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়। রেজল্যুশন তৈরির ১০ দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি ও সংবাদপত্রে এ–সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়।
প্রতিষ্ঠান বাতিল বা নিষ্ক্রিয় করা (স্ট্রাক অফ)
যখন কোনো কোম্পানি আর চলছে না কিংবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমনটা ধরে নেওয়ার উপযুক্ত কারণ থাকে (যেমন বার্ষিক রিটার্ন দীর্ঘদিন জমা দেয়নি), তখন নিবন্ধক কোম্পানির কার্যক্রম অব্যাহত আছে কি না জানতে চেয়ে নোটিশ দেয় আরজেএসসি।
এই প্রথম নোটিশের ৩০ দিনের মধ্যে কোম্পানির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেলে পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে কোম্পানিকে দ্বিতীয় নোটিশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোম্পানি চলছে না বা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, এমন উত্তর পাওয়া যায় অথবা দ্বিতীয় নোটিশের ৩০ দিনের মধ্যে কোনো উত্তর পাওয়া না যায়, তখন ওই কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল ও বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।