বর্তমানে শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন আদায়ের বিধান রয়েছে, তার বদল হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় এ হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে। তবে সরকার ১৫ শতাংশের ব্যাপারে একমত হয়েছে। সরকার বলছে, ভবিষ্যতে এ হার আরও কমানো হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিশেষ প্রতিনিধি সফররত কেলি এম ফে রদ্রিগেজের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দলটি বাংলাদেশ সফর করছে। শ্রম অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি কর্মপরিকল্পনা বা পথনকশা আছে। তার অগ্রগতি জানতেই এবারের বৈঠক।
গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের একটি দল বাংলাদেশের শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের একটি কর্মপরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল সরকারকে। ওই কর্মপরিকল্পনায় মোটাদাগে ১১টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বৈঠকে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে বলে জানান শ্রমসচিব।
১১ দফার প্রথমটিই হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক ও শ্রম অধিকারকর্মীদের যাঁরা নিপীড়ন করেন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এরপরই রয়েছে শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কাজ করে, এমন কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা। এ ছাড়া রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো যে মানের অধিকার ভোগ করে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংশোধন এবং বিদ্যমান শ্রমবিধির সংশোধন।
১১ দফা কর্মপরিকল্পনার অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) শ্রমিকেরা যাতে পুরোদমে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া; বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইনের ৩৪ নম্বর ধারা সংশোধন; বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় (এসইজেড) সেটির প্রয়োগ এবং সেখানকার শ্রমিকেরা যাতে সংগঠিত হতে পারেন ও সম্মিলিতভাবে দর-কষাকষিতে সক্ষম হন, তা নিশ্চিত করা; ট্রেড ইউনিয়ন করার আবেদনের প্রক্রিয়া ৫৫ দিনের মধ্যে শেষ করা; শ্রম অধিদপ্তরের মাধ্যমে তার বিদ্যমান অনলাইন নিবন্ধন পোর্টালে অপেক্ষমাণ থাকা সব আবেদনের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ; বার্ষিক বাজেটের মাধ্যমে শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ এবং এ জন্য তহবিল বরাদ্দ করা; আরও শ্রম পরিদর্শকের পদ অনুমোদন এবং নিবন্ধন বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করার অভ্যাস বন্ধ করা ইত্যাদি।
মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে শ্রম অধিদপ্তর ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রমসচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে শ্রমিকনেতাদের অসন্তোষ আছে। প্রশ্নটি অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দলটিও এমন প্রশ্ন তুলেছে। কয়েকটি সরকারি দপ্তর পরিদর্শন করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। কাগজে-কলমের (ম্যানুয়াল) বদলে অনলাইনে আবেদনের জন্য একটা সফটওয়্যার তৈরি হচ্ছে। এ জন্য কারিগরি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে। বিষয়টিকে শত ভাগ স্বচ্ছ করতে চাই। অনলাইন হয়ে গেলে কাউকে সরাসরি এসে আর দর-কষাকষি করতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের দলটি বলেছে, এটা তারা কার্যকর দেখতে চায়। আমরা তা কার্যকর করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
১১ দফার কোনটির পরিস্থিতি কী, জানতে চাইলে শ্রমসচিব কথা বলার দায়িত্ব দেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন সরকারকে। তিনি শুধু একটির ব্যাপারে বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন করতে কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের অনুমোদন লাগে। যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছিল এটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে। আমরা আপাতত ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শ্রম অধিকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার পরিস্থিতিও জুড়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে শ্রমসচিব বলেন, ‘মানবাধিকার সার্বিকভাবে একটা বড় বিষয়। কিন্তু শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা, স্বাধীন তদন্ত ইত্যাদি তারা চায়। আমি একমত হয়েছি। তাঁরা বলেছেন, ১১ দফা বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই আমাদের রপ্তানি বাড়বে এবং ন্যায্যমূল্য পাব। ক্রেতাদের তাঁরা বলতে পারবেন যে এখানে মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে। আমি তাদের এ কথাও বলেছি, যেসব কারখানায় সমস্যা চলছে, সেগুলো ব্র্যান্ড-বায়ারদের চালাতে বলো। আমাদের মুনাফার দরকার নেই।’
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) জন্য একধরনের আইন, অন্যদের জন্য আরেক ধরনের আইন—এ নিয়েও তো প্রশ্ন রয়েছে। এর জবাবে শ্রমসচিব বলেন, ইপিজেডের শ্রমিকেরা অন্য শ্রমিকদের তুলনায় বেশি মজুরি ও কর্মপরিবেশের বেশি নিরাপত্তা ভোগ করে। হঠাৎ করে চুক্তির বাইরে যাওয়া যাবে না। একক আইন করতে গেলে একটা সমীক্ষা করতে হবে।
আগামী তিন মাসে দু-একটি ছাড়া ১১ দফার সব কটিরই ভালো অগ্রগতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন শ্রমসচিব। শ্রম সংস্কার কমিশন অনেকটাই সরকারের কাজ সহজ করে দেবে বলেও মনে করেন তিনি।